রাশেদুল ইসলাম রাশেদ।।
প্রতি বছর শিক্ষাবর্ষের ভালো-মন্দ দুটি দিক মিলিয়ে বছর শেষ হয়। চলতি বছর ২০২০ সাল ছিলো ভয়াবহ বছর। বৈশ্বিক মহামারি করোনায় তছনছ করে দিয়েছে গোটা শিক্ষাব্যবস্থাকে। বছরের প্রথম দুই মাস সব কিছুই ঠিকঠাক চলছিল। মার্চ মাস থেকে আঘাত হানে মরণঘাতী করোনা। দীর্ঘ ১০ মাস সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে।
গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা ভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পর ১৭ মার্চ স্কুল-কলেজসহ সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কোচিং সেন্টার বন্ধ ঘোষণা করা হয়। তবে অনলাইনে ক্লাস চলমান। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বিবেচনায় বদলে যাচ্ছে গতানুগতিক শিক্ষা কার্যক্রম।
বিদ্যমান কারিকুলামের আওতায় আসছে নতুন বছর ২০২১ সালজুড়ে শিক্ষা কার্যক্রমে অ্যাসাইনমেন্টের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের ব্যবস্থা অব্যাহত রাখা হবে।
চলতি বছরের এইচএসসি ও সমমান, প্রাথমিক সমাপনী ও সমমান এবং জেএসসি ও সমমান পরীক্ষা বাতিল করে দেয় সরকার। মারাত্মক সেশন জটে আটকা পড়তে পারে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। করোনা প্রার্দুভাবে বর্তমানে অনার্স চতুর্থ বর্ষ, এলএলবি প্রথম পর্ব, মার্স্টাসসহ প্রফেশনাল কোর্সের পরীক্ষা স্থগিত রয়েছে।
এছাড়া অনার্স/ ডিগ্রি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশে বিঘ্ন হচ্ছে। বর্তমানে করোনা প্রাদুর্ভাবে এবার বিঘ্ন ঘটবে বলে আশঙ্কা করছেন শিক্ষার্থীসহ অবিভাবকরা। অপরদিকে সারা দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বড় একটা সেশন জটের শঙ্কায়।
করোনা তার তাণ্ডব চালিয়ে দেশে এখন দ্বিতীয় ঢেউয়ে অবস্থান করছে। এখনো বহির্বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা রয়েছে। এই করোনার সাথে যুদ্ধ করতে গিয়ে দেশে বেশ কয়েকজন শিক্ষাবিদ, শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী প্রাণ হারিয়েছেন।
এছাড়া বিকল্প পন্থায় শিক্ষা কার্যক্রম চালাতে গিয়ে শিক্ষামন্ত্রী, সচিব, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীসহ শিক্ষা খাত সংশ্লিষ্ট হাজারো লোক আক্রান্ত হয়েছেন মরণঘাতী করোনায়। পাঠকের জন্য ২০২০ সালের ঘটে যাওয়া শিক্ষা খাত সংশ্লিষ্ট উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরা হলো—
করোনার আঘাতে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের প্রথম ঘোষণা : করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গত ১৭ মার্চ থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয় মন্ত্রিসভা। ১৬ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে ওই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার বিষয়টি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল।
এ বিষয়ে পরে সচিবালয়ে ব্রিফিং করেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি। মন্ত্রী বলেন, সংক্রমণ এড়াতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। স্কুলে থাকছি না মানে শিক্ষার্থীদের বাড়িতে থাকতে হবে। বাড়ির বাইরে বের হওয়া যাবে না। স্কুল বন্ধ বলে পার্কে গেলাম, ঘুরতে গেলাম, আত্মীয়-স্বজনের বাসায় গেলাম। এর ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। এসব করা যাবে না। বাড়ির বাইরে শিক্ষার্থীরা বের হতে পারবে না।’
দীপু মনি জানান, শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, সব ধরনের কোচিং সেন্টারও বন্ধ থাকবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ, এখন যদি শিক্ষার্থীরা মনে করে কোচিং সেন্টারে যাবে, তা হবে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কয়েক দফা বন্ধ ঘোষণা করে চলমান ছুটি আগামী নতুন বছর ২০২১ সালের ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
অনলাইন ক্লাসের সুফল শহরে, পিছিয়ে পড়ে প্রান্তিক শিক্ষার্থীরা : করোনা ভাইরাসের কারণে সরকার গত মার্চে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণার পর এপ্রিল পর্যন্ত ঈদসহ নানা ছুটির কারণে মে মাস থেকেই অনলাইনে শিক্ষার্থীদের পড়ানোর কাজ শুরু করে অনেক স্কুল। সরকার প্রথমের দিকে জাতীয় সংসদ টিভিতে ক্লাস চালু করে। এরপর বাংলাদেশ বেতারেও প্রাথমিকের শিশুদের জন্য ক্লাস শুরু হয়।
এছাড়াও স্থানীয়ভাবে শিক্ষকরা মোবাইল, ভিডিও কন্টেনের মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যান। এতে করে টিভি, অনলাইন ক্লাসের সুবিধা শহরের ছেলেমেয়েদের ভালোভাবে হলেও পিছিয়ে পড়ে প্রান্তিক শিক্ষার্থীরা। বেশির ভাগ গ্রামের শিক্ষার্থীদের স্মার্টফোন, টিভি, ইন্টারনেট সুবিধা না থাকায় পড়াশোনায় অনেকটায় পিছিয়ে পড়ে।
শহরাঞ্চলে অনেক স্কুলই শিক্ষার্থীদের জন্য চালু করে অনলাইন ক্লাসরুম। মে মাসের শুরু দিক থেকেই বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তাদের অনলাইন ক্লাস শুরু করে। কখনো ফেসবুক লাইভ কিংবা জুম ব্যবহার করে শিক্ষকরা তাদের ক্লাস নিচ্ছেন। গ্রামাঞ্চলের স্কুলগুলোতে ইন্টারনেট বা অনলাইনভিত্তিক শিক্ষাদান সম্ভবপর হচ্ছে না।
ডিজিটাল প্রযুক্তি সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীর সংখ্যা জানে না কেউই : সরকারি হিসেবে দেশে প্রাথমিক স্কুল আছ ৬৪ হাজার আর অন্যদিকে সরকারি বেসরকারি মিলিয়ে মাধ্যমিক স্কুল আছে আরও ১৭ হাজারের মতো।
আর কলেজ বা মহাবিদ্যালয় আছে প্রায় আড়াই হাজার। আর সব মিলিয়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় পাঁচ কোটি। যদিও এর মধ্যে অল্প একটি অংশই এই করোনা পরিস্থিতিতে অনলাইনে শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে আর টিভি দেখার সুযোগ আছে সব মিলিয়ে ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থীর। অর্থাৎ এখনো বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী ডিজিটাল শিক্ষা কার্যক্রমের আওতার বাইরেই রয়ে গেছে।
এইচএসসিতে অটোপাস : গত ৭ অক্টোবর শিক্ষামন্ত্রী এক ঘোষণায় চলতি বছর এইচএসসি পরীক্ষা না নেয়ার কথা জানিয়েছেন। ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি ২০২০ সালের এইচএসসি পরীক্ষা সরাসরি গ্রহণ না করে জেএসসি ও এসএসসির ফলের গড় অনুযায়ী এইচএসসির ফল নির্ধারণের কথা জানান। ২০১৯-২০ এইচএসসি ও সমমানের ফলাফল চলতি মাসের শেষ দিকে প্রকাশ করা হবে বলে জানান মন্ত্রী।
অটোপাসের নম্বরপত্র নির্ধারণ করতে জাতীয় পরামর্শক কমিটি একটি খসড়া নীতিমালা শিক্ষামন্ত্রীর কাছে পাঠায়। সেটি যাচাই-বাছাই শেষে অনুমোদন পেলেই এক সপ্তাহের মধ্যে ফলাফল তৈরির কাজ সম্পন্ন হবে।
নীতিমালা অনুযায়ী, পরীক্ষার্থীদের বিষয়ভিত্তিক নম্বর নির্ধারণ করা হবে। তার মধ্যে জেএসসিতে ২৫ শতাংশ এবং এসএসসিতে প্রাপ্ত নম্বরের ওপর ৭৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হবে। যারা জেএসসিতে অংশগ্রহণ করেনি তাদের ক্ষেত্রে শতভাগ নম্বর এসএসসি পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরের ওপর নির্ধারণ করা হবে।
কেউ আগের দুই পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেলেও অতিরিক্ত বিষয়ে ও ব্যবহারিক পরীক্ষার নম্বর যুক্ত থাকলে তাদের ক্ষেত্রে এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পরিবর্তন হতে পারে। বিষয়-ভিত্তিক ইমপ্রুভমেন্ট পরীক্ষার্থীদের ক্ষেত্রেও একই সূত্র অনুসরণ করতে নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে।
বদলে যাচ্ছে ২০২১ সালের শিক্ষা কার্যক্রম : করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বিবেচনায় বদলে যাচ্ছে গতানুগতিক শিক্ষা কার্যক্রম। বিদ্যমান কারিকুলামের আওতায় ২০২১ সালজুড়ে শিক্ষা কার্যক্রমে অ্যাসাইনমেন্টের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের ব্যবস্থা অব্যাহত রাখা হবে। একই সঙ্গে ২০২০ শিক্ষাবর্ষের ঘাটতি পূরণ করতে শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন বছরে বিশেষ ব্যবস্থাও নেয়া হবে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, করোনা পরিস্থিতির কারণে ২০২০ সালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার কোনো সম্ভাবনা এখনো নেই। এ ছাড়া আগামী বছরের মার্চ পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকতে পারে। সে কারণেই আগামী বছরের শিক্ষা কার্যক্রম কেমন হবে তার প্রস্তুতি এখন থেকেই নেয়া হচ্ছে।
শিক্ষার্থীদের জন্য আগামী জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসের অ্যাসাইনমেন্ট তৈরির প্রস্তুতি নিয়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড। অন্যদিকে এখন থেকে বছরজুড়েই অ্যাসাইনমেন্টের মাধ্যমে শিক্ষার্থী মূল্যায়ন করার প্রস্তুতি নিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর।
করোনার প্রভাব না থাকলেও অ্যাসাইনমেন্ট ব্যবস্থা চালু থাকবে। একইসঙ্গে চলতি শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থীর ঘাটতি পূরণেও ২০২১ শিক্ষাবর্ষে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ জন্য নতুন বইসহ পুরনো বছরের বই শিক্ষার্থীদের সংগ্রহে রাখতে হবে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ২০২১ সালের ১ জানুয়ারিতে শিক্ষার্থীদের কাছে পাঠ্যবই পৌঁছে দেয়া হবে। এছাড়া অ্যাসাইনমেন্ট ব্যবস্থা ছাড়াও অনলাইনে পাঠদান, ভিডিও রেকর্ড করা পাঠদান চলবে। করোনা পরিস্থিতি না থাকলেও সারা বছর অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হবে।
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ গোলাম মো. ফারুক বলেন, ‘দীর্ঘদিন থেকে আমরা ফরমেটিভ অ্যাসেসমেন্ট ব্যবস্থা চালুর চেষ্টা করছি। কিন্তু পারিনি। করোনা পরিস্থিতির কারণে ফরমেটিভ অ্যাসেসমেন্টে নভেম্বর থেকে শুরু করতে হয়েছে। সেটা শিক্ষার্থীদের জন্য খুবই কার্যকর হয়েছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা এটিকে ভালোভাবে নিয়েছে। এই ব্যবস্থা শুধু পরীক্ষানির্ভর। তাই করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব না থাকলেও আমরা আগামী বছর এটি চালু রাখবো।’
তিনি আরও বলেন, ‘ফরমেটিভ অ্যাসেসমেন্ট ব্যবস্থায় ফাঁকি দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের অ্যাসাইনমেন্ট সম্পর্কে জানতে চাইলে বা অ্যাসাইনমেন্ট দেখলেই বুঝতে পারবেন শিক্ষার্থী নিজে করেছে কি-না। যদি নিজে না করে তাহলে আবার তাকে একই অ্যাসাইনমেন্ট দেবেন শিক্ষকরা।’
অধ্যাপক ড. সৈয়দ গোলাম মো. ফারুক বলেন, ‘শিক্ষার্থীর অ্যাসাইনমেন্ট শিক্ষকের কাছে যাওয়ার পর দুর্বলতা খুঁজে পাবেন। ওই অ্যাসাইনমেন্টের দুর্বলতা নির্ণয় করে শিক্ষার্থীকে দেয়া হবে। শিক্ষার্থীরা তখন তাদের দুর্বলতা বুঝতে পারবে। শিক্ষকরা দুর্বলতা বুঝে শিক্ষার্থীকে শেখাতেও পারবেন। প্রয়োজনে আবার অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে শিক্ষক শিক্ষার্থীকে নির্দিষ্ট পাঠের জন্য সক্ষম করে তুলবেন।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক ড. মশিউজ্জামান বলেন, করোনার প্রাদুর্ভাবের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না খুললেও ২০২১ সালের তিন মাসের (জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ও মার্চ) অ্যাসাইনমেন্ট প্রস্তুত করবো। এছাড়া অনলাইন ক্লাসও চলবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা সম্ভব হলেও অনলাইন ক্লাস চলবে।
২০২০ সালে শিক্ষা কার্যক্রমে থাকা ঘাটতির জন্য কিছু নির্দেশনা তৈরি করা হয়েছে। এছাড়া আগামী বছর আমাদের একটি প্যাকেজ চালু থাকবে, যেখানে পুরনো কারিকুলামে নতুন কারিকুলামের কিছু কনটেন্ট থাকবে। এছাড়া শিক্ষার্থীদের জন্য প্রজেক্ট ওয়ার্ক থাকবে।
কিন্ডারগার্টেন স্কুল খুলে দেয়ার দাবি : কিন্ডারগার্টেন স্কুল খুলে দেয়াসহ তিন দফা দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে জাতীয় কিন্ডারগার্টেন স্কুল কলেজ ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ঐক্য পরিষদ এবং বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন স্কুল কলেজ অ্যাসোসিয়েশন। গত ৯ নভেম্বর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে তারা এ অবস্থান কর্মসূচি পালন করে।
অবস্থান কর্মসূচিতে ঐক্য পরিষদের সভাপতি মো. আহসান সিদ্দিকী বলেন, ‘দেশের প্রায় সব কিন্ডারগার্টেন স্কুল, কলেজ ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান নিজস্ব অর্থায়নে ভাড়াবাড়িতে পরিচালনা করা হয়ে থাকে। সারা দেশে প্রায় ৬৫ হাজারের মতো এ রকম প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এতে প্রায় ১২ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োজিত। এসব প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণভাবে ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত টিউশন ফিতে পরিচালিত হয়।
তিনি বলেন, ‘গত ১৬ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। এরপর থেকে কিন্ডারগার্টেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও অচল হয়ে পড়ে। প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রায় আট মাসের বাড়িভাড়া দেয়া সম্ভব হয়নি। এমনকি শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। বাড়িওয়ালারাও প্রতিনিয়ত ভাড়ার জন্য চাপ দিচ্ছেন। এ অবস্থা চলতে থাকলে আমাদের ৮০ ভাগ প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে এবং লাখ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী ও পরিচালক বেকার হয়ে যাবেন।
এই সেক্টরে সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করে আহসান সিদ্দিকী বলেন, ‘আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে যদি শিক্ষকদের দাবি না মানা হয়, তাহলে আমাদের জীবন রক্ষার আর কোনো উপায় থাকবে না।’ এ সময় তাদের দাবিগুলো মেনে নেয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
তাদের দাবিগুলো হলো— করোনা দুর্যোগকালীন কিন্ডারগার্টেন স্কুল-কলেজ ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান পরিচালকদের উদ্যোক্তা ঘোষণার মাধ্যমে সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে, ২০২১ সালের ভর্তির সুনির্দিষ্ট দিক-নির্দেশনা দিতে হবে এবং বার্ষিক মূল্যায়ন পরীক্ষা নেয়ার সুযোগ দিতে হবে।
টিউশন ফি ছাড়া অন্য খাতে টাকা নেয়া যাবে না : করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন থাকা অভিভাবকদের ছাড় দিয়ে স্কুল-কলেজগুলো শিক্ষার্থীদের শুধুই টিউশন ফি নিতে পারবে। তবে শিক্ষার্থীদের অ্যাসাইনমেন্ট, টিফিন, পুনরায় ভর্তি, গ্রন্থাগার, বিজ্ঞানাগার, ম্যাগাজিন ও উন্নয়ন বাবদ কোনো ফি নেয়া যাবে না, বা নিলেও তা ফেরত দিতে হবে। গত ১৮ নভেম্বর মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ মো. গোলাম ফারুকের সই করা বিজ্ঞপ্তিতে এ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, করোনা সংক্রমণের কারণে গত ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। তবে এরই মধ্যে সংসদ টেলিভিশনে প্রচারিত ক্লাসের পাশাপাশি বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কার্যকরভাবে অনলাইন ক্লাসের ব্যবস্থা করলেও কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তা ভালোভাবে করতে পারেনি। একইভাবে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী এসব অনলাইন ক্লাসে অংশ নিতে পেরেছে, কিছু শিক্ষার্থী পারেনি।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এমতাবস্থায় আমাদের যেমন অভিভাবকদের অসুবিধার কথা ভাবতে হবে, অপরদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যেনো বন্ধ বা অকার্যকর হয়ে না যায়, কিংবা বেতন না পেয়ে শিক্ষক-কর্মচারীদের জীবন যেনো সংকটে পতিত না হয়, সেটাও খেয়াল রাখতে হবে। পূর্বাপর বিষয়গুলো বিবেচনা করে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের আওতাধীন বেসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো (এমপিওভুক্ত ও এমপিওবিহীন) শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টিউশন ফি নেবে।
কিন্তু অ্যাসাইনমেন্ট, টিফিন, পুনঃভর্তি, গ্রন্থাগার, বিজ্ঞানাগার, ম্যাগাজিন ও উন্নয়ন বাবদ কোনো ফি নিতে পারবে না বা নিয়ে থাকলে তা ফেরত দেবে, অথবা তা টিউশন ফির সঙ্গে সমন্বয় করবে।
এছাড়া অন্য কোনো ফি যদি অব্যয়িত থাকে, তা একইভাবে ফেরত দেবে বা টিউশন ফির সঙ্গে সমন্বয় করবে। তবে যদি কোনো অভিভাবক চরম আর্থিক সংকটে থাকেন, তাহলে ওই শিক্ষার্থীর টিউশন ফির বিষয়টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ বিশেষ বিবেচনায় নেবে।
উল্লেখ্য, কোনো শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন যেনো কোনো কারণে ব্যাহত না হয়, সে বিষয়টি সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট সবাইকে যত্নশীল হতে হবে।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, ২০২১ সালের শুরুতে যদি কোভিড-১৯ পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হয়, তাহলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে এমন কোনো ফি, যেমন— টিফিন, পুনঃভর্তি, গ্রন্থাগার, বিজ্ঞানাগার, ম্যাগাজিন, উন্নয়ন ফি নেবে না, যা ওই নির্দিষ্ট খাতে শিক্ষার্থীদের জন্য ব্যয় করতে পারবে না। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে পুনরায় আগের মতো সব ধরনের যৌক্তিক ফি নেয়া যাবে।
তবে শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি নিয়ে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অভিভাবকদের মতদ্বৈততা পরিলক্ষিত হচ্ছে। কিছু অভিভাবক বলছেন, একদিকে স্কুল বন্ধ ছিলো আর অপরদিকে করোনার সময়ে তারা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। অতএব, তাদের পক্ষে টিউশন ফি দেয়া সম্ভব নয়।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, তারা শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন অব্যাহত রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে। উপরন্তু প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন ও স্কুল রক্ষণাবেক্ষণ খাতে প্রতি মাসে তাদের একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতেই হয়।
ভার্চুয়ালি বই উৎসবের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী : প্রতি বছর গণভবনে শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দিয়ে বই উৎসবের উদ্বোধন করলেও এবার করোনা পরিস্থিরির কারণে ভার্চুয়ালি উৎসবের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আগামী ৩১ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের বই তুলে দিয়ে এর উদ্বোধন করবেন। এরপর নতুন বছর সারা দেশে শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বছরের বই তুলে দেয়া হবে। তবে করোনার কারণে এবার স্কুলে স্কুলে উৎসব হবে না বলে আগেই জানিয়ে দিয়েছে শিক্ষার দুই মন্ত্রণালয়। প্রতি বছর ১ জানুয়ারিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে আলাদা করে ঢাকায় কেন্দ্রীয়ভাবে পাঠ্যপুস্তক উৎসব পালন করা হয়ে থাকে। করোনা পরিস্থিতির কারণে এবার এ উৎসব বাতিল করা হয়েছে।
মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, অন্যান্য বছর নতুন বছরের পাঠ্যপুস্তক গণভবনে প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করে থাকেন। এবার করোনার কারণে এবার শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দুই মন্ত্রী ও সচিব, পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের চেয়ারম্যান ও শিক্ষার্থীরা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে উপস্থিত থাকবেন। সেখানে ভার্চুয়ালি প্রধানমন্ত্রী পাঠ্যবইয়ের মোড়ক উন্মোচন করবেন।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলেছেন, বই উৎসব না হলেও পহেলা জানুয়ারি বিকল্প পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেয়া হবে। যথারীতি অন্যান্য বছরের মতো এবারো আগের দিন ৩১ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী নতুন বছরের বই বিতরণের উদ্বোধন ঘোষণা করবেন। করোনার কারণে এবার সীমিত পরিসরে তা হবে।