আসাদুল ইসলাম সবুজ ।।
আপন আলোয় উদ্ভাসিত জয়িতারা। অভাব, অনটন ও বঞ্চনার করাল গ্রাস থেকে বেরিয়ে আসা জয়িতাদের সাফল্যের গল্পগুলো আসলেই ঈর্ষণীয়। দৃঢ় মনোবল, অদম্য সাহস, সততা আর আপন কর্মকে সঙ্গী করে জীবনযুদ্ধের কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তারা আজ আপন আলোয় উদ্ভাসিত। পাশাপাশি অনুকরণীয় দৃষ্টান্তও বটে। তাদেরই একজন সমাজকর্মী জয়িতা। একজন সংগ্রামী অপ্রতিরোধ্য নারীর প্রতীকী নাম জয়িতা। নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের মূর্ত প্রতীক জয়িতা। কেবল নিজের অদম্য ইচ্ছাকে সম্বল আর চরম হুমকি ধমকির প্রতিকুলতাকে জয় করে জয়িতারা তৃণমূল থেকে সবার অলক্ষ্যে সমাজে নিজের জন্য জায়গা করে নিয়েছেন।

ছবি: সংগৃহীত
সমাজের অর্থনৈতিক, শিক্ষা, সমাজ উন্নয়নসহ নারী নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে যেসব নারী সাফল্যের আলোয় নিজেকে উদ্ভাসিতদের সরকারের মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর এই জয়িতাদের খুঁজে বের করে সম্মাননা-সংবর্ধনাও দিয়েছেন। আমি এতক্ষণ যার কথাগুলো বলছিলাম তিনি আর কেউ নয়, তিনি হলেন সফল সমাজকর্মী ও জয়িতা মোছাঃ রুকশাহানারা সুলতানা মুক্তা। প্রতিবন্ধীদের প্রতি যার হৃদয়ে আঙ্গিনার সবটুকু দরদ আর ভালবাসা দিয়ে পারিশ্রমিক ছাড়াই গত ১৫ বছর ধরে বাড়ি বাড়ি গিয়ে শারীরিক ফিজিওথেরাপি সেবা দেওয়ার পাশাপাশি করেছেন বিনামূল্যে শিক্ষা ব্যবস্থা।

ছবি: সংগৃহীত
সমাজকর্মী জয়িতা মোছাঃ রুকশাহানারা সুলতানা মুক্তা আপার সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে জানা যায়, তার পুরো নাম মোছাঃ রুকশাহানারা সুলতানা মুক্তা। ডাক নাম মুক্তা আপা। বর্তমান মুক্তা আপা নামে সবার কাছে পরিচিত। বয়স প্রায় ৪০ এর কোঠায়। পেশা তিনি একজন সমাজকর্মী, জয়িতা ও একটি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। তার পিতা আলহাজ্ব গিয়াসউদ্দিন, অবসরপ্রাপ্ত সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার। মা সাইয়েদা বেগম, সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা বর্তমান (অবসরপ্রাপ্ত)। বাড়ি লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার সারপুকুর ইউনিয়নের তালুক হরিদাস গ্রামের একটি সম্ভান্ত পরিবারে ১৫ নভেম্বর ১৯৮০ সালে মোছাঃ রুকশাহানারা সুলতানা মুক্তা জন্মগ্রহণ করেন। বর্তমান বসবাস করছেন, জেলা পরিষদ, উকিলপাড়া, আদিতমারী, লালমনিরহাটে। তারা ২ বোন ১ ভাই।

মোছাঃ রুকশাহানারা সুলতানা মুক্তা ১৯৯৫ সালে হরিদাস সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ও হরিদাস দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। ১৯৯৯ সালে সরকারী বেগম রোকেয়া কলেজ, রংপুর থেকে এইচএসসি পাস ও ২০০৮ সাল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএস পাস করেন। এর আগে ২০০০ সাল থেকে মানসিকা কিন্ডারগার্টেন স্কুল থেকে কর্মজীবন শুরু করে মানসিকা ও সুইড বাংলাদেশ পরিচালিত আদিতমারী বুদ্ধি প্রতিবন্ধি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। ২০০৯ সালে ঢাকা সি ডি ডি ও সি আর পি (তালবাগ ঢাকা) এর যৌথ উদ্যোগে একটি প্রজেক্ট মানসিকা প্রতিবন্ধি স্কুলকে সাপোর্ট দেওয়ার জন্য নেদারল্যান্ড সরকার এর অর্থায়নে মানসিকা প্রতিবন্ধী স্কুলের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ গ্রহন করেন।

ছবি: সংগৃহীত
সেই সময় তিনি শিক্ষকদের মধ্যে সিএসডিআরপি হিসেবে নির্বাচিত হন। মোছাঃ রুকশাহানারা সুলতানা মুক্তা প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করতে প্রতিবন্ধিতা বিষয়ক স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক ও ফিজিওথেরাপি স্পিচ থেরাপি সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ, কেয়ারগিভার প্রশিক্ষণ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের ব্র্রেইল পদ্ধতি প্রতিবন্ধিতা প্রতিরোধ বিষয়ক গর্ভবতী মায়ের স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক উঠান বৈঠক, অভিভাবক প্রশিক্ষণ, একীভূত শিক্ষা ও শিক্ষা উপকরণ তৈরি, আয় বৃদ্ধিমূলক কর্মকান্ড বা আইজিএ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ ইউনেস্কো জাতীয় কমিশন শিক্ষা মন্ত্রণালয় ঢাকা এর অর্থায়নে মাস্টার ট্রেইনার প্রমোশন প্রশিক্ষক, আদিতমারী উপজেলার ১২৭টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকগনে ও লালমনিরহাটে ২০টি কেজি স্কুলের দুইজন করে শিক্ষককে প্রশিক্ষণ। ২০১৮ সালে লালমনিহাট ও কুড়িগ্রাাম জেলার ২২টি প্রতিবন্ধী স্কুলে শিক্ষকগণকে প্রশিক্ষণ প্রদান এবং মাস্টার ট্রেইনার হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন মোছাঃ রুকশাহানারা সুলতানা মুক্তা। এ ছাড়াও তিনি লালমনিহাট জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের নির্দেশে রাজশাহী বগুড়া বিভিন্ন অঞ্চলে মাস্টার ট্রেইনার প্রশিক্ষক হিসেবে অংশ গ্রহন করেন।

ছবি: সংগৃহীত
বর্তমানে লালমনিহাট সমাজসেবা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক এর নির্দেশে জেলা জজ আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের ইশারা ভাষা বদলে দেওয়া সহযোগিতা করে আসছেন। তিনি লালমনিরহাট জেলার সর্বত্রই একজন ইশারা ভাষায় এক্সপার্ট ও গবেষক হিসেবে কাজ করেছেন। একজন নারী উদ্যোক্তা হয়ে বিভিন্ন অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে জন্মভূমি গ্রামের বাড়িতে দুইটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছেন। মোছাঃ রুকশাহানারা সুলতানা মুক্তার বাবার দেয়া জমিতে প্রতিষ্ঠান হয়েছে যার নাম সারপুকুর অটিস্টিক ও প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়। প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নে প্রতিষ্ঠা করেছেন প্রতিবন্ধী উন্নয়ন সংস্থা। বর্তমান ২ প্রতিষ্ঠানের একটিতে শিক্ষকতা ও অন্যটিতে নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। বর্তমান প্রতিবন্ধীদের নিয়েই দিন কাটে মোছাঃ রুকশাহানারা সুলতানা মুক্তা। গেল ১৫ বছর ধরে বাড়ি বাড়ি গিয়ে শারীরিক প্রতিবন্ধীদের দিচ্ছেন ফিজিওথেরাপি সেবা। বিনা বেতনে ফিজিওথেরাপিসহ করান বিভিন্ন ধরনের ব্যায়াম। মূলত হাত, পা ও মুখের বিভিন্ন ধরনের থেরাপি দিয়ে থাকেন মুক্তা। গ্রামের নারীদের সচেতনতায় প্রতিবন্ধী বিষয়ে আয়োজন করে উঠোন বৈঠকও।

ছবি: সংগৃহীত
আর এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা। প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষা পুনর্বাসন, স্বাস্থ্যসেবা, প্রতিবন্ধীদের জীবনমাননোন্ননের প্রচেষ্টা, নিজ অর্থায়নে প্রতিবন্ধী শিশুর গর্ভবতী মায়ের প্রতিবন্ধিতা প্রতিরোধ বিষয়ক স্বাস্থ্য সচেতনতা, নারী ও শিশু পাচার রোধ, নারী ও শিশুদের যৌন হয়রানী, নারী নির্যাতন, প্রতিবন্ধী শিশু ও নারীদের অধিকার অর্জনে কাজ করছেন। এক যুবতী, সংগ্রামী নারী মুক্তির কথা, রইতে নারি অন্বেষণ, বেগম রোকেয়া ও নারী দিবসে পেয়েছেন সম্মাননা পুরস্কার ও সনদপত্র। উপজেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ জয়িতাদের সম্মাননা ও সার্টিফিকেট পেয়েছি।

ছবি: সংগৃহীত
সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদানের জন্য নারী ক্যাটাগরিতে জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ জয়িতার পুরস্কার পান। নিজস্ব অর্থায়নে ও প্রশাসনের সহযোহিতায় মাক্স বিতরণ, ১৫ জনের শারীরিক প্রতিবন্ধি শিক্ষার্থীর মাঝে হুই্ল চেয়ার প্রদান, ৫০০জনের মাঝে ত্রান বিতরন, ২০০ জনের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ, প্রতিবন্ধি ব্যাক্তিদের আয়বৃদ্ধি মুলক প্রশিক্ষন প্রদান, প্রতিবন্ধিতা প্রতিরোধ ও বল্যবিবাহ প্রতিরোধ, করোনা সচেতন, জেলার ৫টি উপজেলায় সচেতনতামুলক প্রশিক্ষন প্রদান, প্রতিবন্ধি শিশুদের কাটা ঠোট কাটাতালু অপারেশন, বিনামুল্যে অপারেশন, বছরে ৩ জন প্রতিবন্ধি ও দুঃস্থ নারীসহ ৫ জন পুরুষকে পুনর্বাসন, দুই জন শিশুকে পাচারের হাত থেকে রক্ষা করা, ১১ জন প্রতিবন্ধি নারীকে আইন সহায়তা প্রদান, জেলখানায় প্রতিবন্ধি নারী ও পুরুষের জবানবন্দী রেকর্ডে সহায়তা করা। নিজ অর্থানে প্রতিবন্ধী উন্নয়ন সংস্থার সহযোহিতায় ১০টি সেলাই মেশিন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু, একটি নার্সারী, পেঁপে, লিচু ও ফুলের বাগান, প্রতিবন্ধি শিক্ষার্থীর মধ্যে মানসিক ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধি তারাই নিয়মিত এই বাগানের পরিচর্যাকারী, হাতে কলমে প্রশিক্ষণের কাজ বাস্তবায়ন করছেন। এ ভাবে পর্যায়ক্রমে ২০১৩ জন প্রতিবন্ধি শিক্ষার্থী লেখাপড়ার পাশাপাশি এই প্রশিক্ষণ পাবেন। বাক ও শ্রবন প্রতিবন্ধি মেয়েদের সেলাই মেশিন চালানো, মোমবাতি প্রশিক্ষণ চালু আছে। কেবল নিজের অদম্য ইচ্ছাকে সম্বল আর নিজের চেষ্টায় জীবন যুদ্ধে সংগ্রাম করে আজ তিনি গর্বিত। শুধু তাই নয়, একজন সফল জয়িতা হওয়ার গৌরবও অর্জন করেছেন তিনি।

ছবি: সংগৃহীত
এ বিষয়ে মোছাঃ রুকশাহানারা সুলতানা মুক্তা আপা বলেন, একজন নারী হিসেবে আমি বলবো আমার এই অর্জনের পেছনে অনেক ঘাত প্রতিঘাত লাঞ্ছনা-গঞ্জনা অনেক অবহেলার শিকার হয়েছি। তবুও আমার জীবন থেমে থাকেনি। স্বামীর ঘর সংসার সন্তান সামলানোর পর নিজে লেখাপড়া চালিয়ে গিয়েছি। মিতাশি নারী-পুরুষ কোন ভেদাভেদ নেই। আমি দেখিয়ে দিতে চাই একজন পুরুষ যে আকারে নারীরাও তাই পারে ।